চুনাতি অভয়ারন্য,মালকা বানুর মসজিদ ও দীঘি,বাইক্কা বিল ভ্রমন নির্দেশিকা
চুনাতি অভয়ারন্য:
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও অভয়ারন্যগুলো গড়ে তোলা হয়েছে তার
মধ্যে অন্যতম একটি হলো চুনাতি অভয়ারন্য। স্থানীয়দের কাছে এটি চুনাতি বা চুনুতি অভয়ারন্য নামেও পরিচিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার
মহাসড়কের পাশে এর অবস্থান যা চট্টগ্রামের বাশখালি, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ৭৭৬৪ হেক্টর বা ৭৭ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।
মূলত এ অঞ্চলে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক বনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষনের জন্য ১৯৮৬ সালে এই অভয়ারন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে বন্য
এশিয় হাতির যাতায়াতের জন্য অন্যতম করিডোর হিসেবে এই অভয়ান্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
এ ছাড়া এই অভয়ারন্য তার বিশালাকায় শতবর্ষী মাদার গর্জন গাছ এবং অন্য আরও অনেক উদ্ভিদ
ও প্রাণীর জন্যও সুপরিচিত। চুনাতি অভয়ারন্যটি মূলত টিলাময় এবং এর অনেক জায়গায় পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি এবং প্রচুর অগভীর ও গভীর খাদ রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অভয়ারণ্যের গড় উচ্চতা
৩০ থেকে ৯০ মিটার। বনের ভেতর দিয়ে বহু সংখ্যক কাড়ি বা পাহাড়ি ছড়া একেবেকে বয়ে গেছে যা অভয়ারণ্যে বাস করা প্রাণীদের জন্য পানির উৎস হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে চুনাতি
বনে প্রায় ১২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায় যার মধ্যে প্রায় ৪৫ প্রজাতির উচু গাছও রয়েছে। এ ধরনের বিভিন্ন উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি হলো গর্জন, রাকতান, কাম, চাপালিশ,
শিমূল, কড়ই প্রভৃতি। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ভেষজ উদ্ভিদ এবং লতাগুল্মের ও দেখা মেলে এ বনে। অন্যদিকে একসময় এই বনে ১৭৮ প্রজাতির জীবজন্তু ও পাখির দেখা মিললেও বর্তমানে এ
গুলোর অধিকাংশই বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায়। এ কারণে এখন চুনাতি অভয়ারণ্যে মাত্র ২ প্রজাতির উভচর, ২ প্রজাতির সরীসৃপ, ২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং প্রায় ১১ ধরনের পাখিই বেশি
দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো হাতি, কয়েক ধরনের বিড়াল, বন্যশুকর, হনুমান প্রভৃতি প্রানী এবং কাঠঠোকরা, ছোট বসন্ত বৌরি, বনস্পতি,
কানাকুয়া, আবাবিল, টিলাঘুঘু, ফিঙ্গে, বনময়না, ভাত শালিক প্রভৃতি পাখি। এ ছাড়া চুনাতি অভয়ারণ্যে বেশ কিছু জলজ প্রাণীও দেখতে পাওয়া যায়।
মালকা বানুর মসজিদ ও দীঘি বিলুপ্তির পথে:
চট্টগ্রামের মালকা বানু-মনু মিয়ার প্রেম উপখ্যান ইতিমধ্যে লোকগাথা, যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক ও পূর্নদৈর্ঘ্য চলচিত্র নির্মিত হয়েছে।
তাদের প্রেম কাহিনী নিয়ে রচিত এসব যাত্রাপালা, নাটক, সিনেমা দেশের সর্বত্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাদের প্রেম উপাখ্যান অনেকের কাছে কল্পিত কাহিনী বা
রূপকথা মনে হলেও বা¯তবে কিন্তু তা নয়। মালকা বানু মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান ছিল বাস্তবভিত্তিক প্রেম কাহিনী। ইতিহাস খ্যাত মালকা বানু –মনু মিয়ার প্রেম
উপাখ্যানের অন্যতম কালজয়ী স্বাক্ষী বাশখালীর সরল ইউপিতে অবস্থিত মালকা বানুর মসজিদ ও দীঘি। মালকা বানুর পিতার নাম আমির মোহাম্মদ চৌধুরী।
বাশখালীর সরল গ্রামে ছিল তাদের বসতি এবং জমিদার এষ্টেট। সরল গ্রামে মালকা বানুর নামে রয়েছে একটি প্রাচীনতম মসজিদ ও বিলুপ্ত প্রায় একটি দীঘি।
আনোয়ারার জমিদার পুত্র মনু মিয়ার সাথে মালকা বানুর বিয়ে ইতিহাসের এক চমকপ্রদ ঘটনা। ইতিহাসের সূত্র ধরে জানা যায়, মালকা বানু বিবাহকালীন
সময়ে সারাদেশে অনেক মুখরোচক গল্প রয়েছে।
বাশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং আলোড়ন’র সূত্র ধরে জানা যায়, আমির মোহাম্মদ চৌধুরী নামে এক
ব্যাক্তি সরলে বসবাস করতেন এবং তিনি ছিলেন প্রভাবশালী ও জমিদার। তার আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা ছিল ইতিহাস খ্যাত মালকা বানু চৌধুরী।
মালকা বানু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আনোয়ারার জমিদার পুত্র মনু মিয়ার সাথে। তাদের সংসারে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হলে মালকা বানু স্বামীর সাথে
অভিমান করে পিতৃবাড়ী বাশখালীর সরলে চলে আসেন। সরলে বর্তমানে যে মসজিদ এবং দীঘি স্মৃতি হিসাবে দাড়িয়ে আছে ওই মসজিদটি মালকা বানুর
পিতা আমির মোহাম্মদ নির্মাণ করে বলে দাবি করেন এবং তাতে ফরাসি ভাষায় একটি শিলালিপি ছিল। যা পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগে বিলীন
হয়ে যায়। শত শত বছরের প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতিবহ মসজিদটির প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে বিশাল দীঘিটি বর্তমানে ভরাটের দ্বারপ্রান্তে।
মালকা বানুর মসজিদ ও দীঘিকে পুন: সংস্কার করা না গেলে ইতিহাস থেকে মুছে যাবে মালকা বানুর স্মৃতি। মালকা বানুর মসজিদটি অত্যন্ত জীর্নশীর্ণ
অবস্থায় পড়ে থাকলেও বিশাল আকারের দীঘিটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ওই দীঘিতে শুস্ক মৌসুমে লবন চাষ এবং বর্ষা মৌসুমে মাছ চাষ করেন স্থানীয় জনগন।
বাইক্কা বিল:
বিস্তির্ণ জলরাশি আর সেই জলের মেলায় নানা জাতের পাখির কলকাকলি যাদের ভালোলাগে ঠিক তাদের জন্যই বেড়ানোর
চমৎকার এক স্থান হতে পারে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিল। নানা জাতের পাখি আর মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে ইতোমধ্যেই বহু মানুষের কাছে
আলাাদা কদর লাভ করেছে এই বিলটি। শ্রƒীমঙ্গল শহর ছেড়ে মৌলভীবাজার সড়কে কিছু দূর চলার পথে মূল সড়ক ছেড়ে পাকা-কাচা বেশ কিছুটা পথ পাড়ি
দিয়ে পৌছুতে হয় বিলের প্রবেশপথে যেখানে হাইল হাওরের প্রায় একশ হেক্টর জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে এই বাইক্কা বিল।
বর্তমানে প্রায় ৯৮ প্রজাতির মাছ আর
১৬০ প্রজাতির পাখির নিরাপদ অভয়াশ্রম এই বিল। এক্ষেত্রে মাছের মধ্যে যেমন আছে আইড়, কই, মেনি, পাবদার মতো দেশীয় মিঠাপানির মাছ তেমনি
আছে নাম না জানা আরও অনেক মাছের বিচরণ। মূলত শীতকালে বিলের পানি যখন একটু কমে যায় তখনই এইসব মাছের বিচরণ বেশি চোখে পড়ে।
যদিও গেল কিছুদিন থেকেই বাইক্কা বিলের মূল আকর্ষণে পরিণত হয়েছে নানা জাতের দেশীয় এবং পরিযায়ী জাতের পাখি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি
পাখির প্রজাতি হলো বেগুনি কালেম, পানকৌড়ি, সাপ পাখি, দলপিপি, নেউ পিপি, পান মুরগি, ধলাবক, কানিবক, গোবক, শঙ্খচিল,
ভুবন চিল, পালাসী কুড়া ঈগল গুটি ঈগল প্রতৃতি বহু রং আর ধরনের পাখি। এছাড়া এই বিলেই দেখা মিলবে পৃথিবীর বিপন্ন পাখির তালিকায় স্থান
পাওয়া পাখি কালোমাথা কাস্তেচোরার। এছাড়া পরিযায়ী পাখি আসার মৌসুমে অর্থাৎ শীতের সময় এখানে আরও দেখা মিলবে বিলের অতিথি পাতি সরালি,
মরচেরং ভুতি হাস, গিরিয়া হাস আর ল্যাঞ্জা হাসের। আর বিলের একটু ভেতরের দিকে প্রবেশ করলে দেখা মেলে মেটে মাথা টিটি, কালাপাখা ঠেঙ্গী,
গেওয়ালা বাটান প্রভৃতি পাখির। এসব পাখিসহ চেনা অচেনা আরও অনেক পাখি দেখার পাশাপাশি বিলে ঘুরে বেড়াতে চাইলে বিলের ধারেই পাওয়া যাবে
নৌকার বন্দোবস্ত। এছাড়া যারা স্রেফ পাখি দেখার জন্যই অনেকটা সময় এখানে থাকতে চান তাদের জন্যও রয়েছে আলাদা একটি ওয়াচ টাওয়ার।
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে, শ্রীমঙ্গল থেকে বাইক্কা বিলে যাবার জন্য ভালো কোনো পরিবহন সেবা নেই বলে সিএনজি অটো রিক্সা বা ভাড়া করা
গাড়ি নিয়েই আপনাকে যাাবর পরিকল্পনা করতে হবে।
|